হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ন্যায় ও ন্যায়বিচার ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এর মূল উৎস হলো কুরআন ও সুন্নাহ। বিভিন্ন ইসলামিক সম্প্রদায়ের মধ্যে শিয়ারা ন্যায় (ঐশিক) এবং ইমামতকে তাদের ধর্মীয় মূলনীতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করে।
ন্যায় ও ন্যায়বিচার ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এর মূল উৎস কুরআন ও সুন্নাহ। শিয়ারা ন্যায় (ঐশিক) এবং ইমামতকে তাদের ধর্মীয় মূলনীতি হিসেবে মান্য করে। ইমাম আলী (আ.)-এর ন্যায় ও ন্যায়বিচারের চিত্র তাঁর প্রথম ইমাম হিসেবে প্রতিফলিত হয়। ইমাম আলী (আ.) ন্যায়বিচারকে একটি দায়িত্ব ও ঐশিক কর্তব্য, বরং একটি ঐশিক আদর্শ হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন। "নাহজুল বালাগা" হলো ইমাম আলী (আ.)-এর একটি অমর রচনা, যেখানে ন্যায়বিচারকে একটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এই গবেষণায় ইমাম আলী (আ.)-এর ন্যায় ও ন্যায়বিচারের অর্থ, তার সুফল এবং ইসলামী শাসনে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারে পৌঁছানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করা হবে। এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সমাজে সাধারণ মানুষের আর্থিক উন্নতি এবং সমৃদ্ধির একটি মাপকাঠি হলো উন্নততার অন্যতম পরিচায়ক। ইসলামের দৃষ্টিতে, এমন একটি লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব কেবলমাত্র এমন একজন ন্যায়পরায়ণ, তাকওয়াবান এবং সাধারণ জীবনযাপনকারী শাসক দ্বারা, যারা জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। এই একই নীতি ছিল, যা ইমাম আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে ছিল এবং তিনি এই বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন।
১) ভূমিকা
ন্যায় শব্দটি আক্ষরিকভাবে সমতা এবং সুষমতা বোঝায়, এবং সামাজিক ধারণায়, যখন প্রতিটি অধিকারী তার অধিকার পায়, তখন বলা হয় যে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং, অর্থনৈতিক ন্যায়, যা সামাজিক ন্যায়ের একটি রূপ, তা হল মানুষের অর্থনৈতিক অধিকারসমূহের যথাযথ প্রদান এবং তাদের প্রাপ্যতা অনুসারে বিচার করা।
এই সংজ্ঞা থেকে আমরা এটি বুঝতে পারি যে, অধিকার ও সুযোগের সমতা এবং সমাজে সুষমতার প্রতিষ্ঠা সর্বদা ন্যায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অধিকারীদের অধিকার সঠিকভাবে দেওয়া না হলে, যে কোন ধরনের সমতা বা সুষমতা একটি অসমতা হিসেবে বিবেচিত হবে। অতএব, অর্থনৈতিক ন্যায় কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সুষমতা নয়, এবং অনেক অর্থনৈতিক তত্ত্বের ব্যর্থতার কারণ হল ন্যায় এবং সুষমতার ধারণাকে এক করে দেখা, যেখানে অনেক সুষমতা শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং কিছু মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে চাহিদা ও যোগানের সুষমতার উপর জোর দেওয়া যেতে পারে: যদি সরকার বা ন্যায় প্রতিষ্ঠার সমর্থকরা হস্তক্ষেপ না করে, তবে বাজারের প্রচলিত প্রক্রিয়াগুলি চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সুষমতা তৈরি করবে, কিন্তু এটি সেই সব সরবরাহকারীকে বাদ দেয় যারা অর্থনৈতিক দৈত্যদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে অক্ষম অথবা দরিদ্রতার কারণে প্রার্থীদের সারিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, এবং এই প্রক্রিয়া সমাজে শ্রেণী বৈষম্যকে গভীর করে তোলে এবং ন্যায়ের মূল ভিত্তি ক্ষুণ্ন করে।
ইসলামি দর্শন কুরআন এবং ধর্মীয় নেতা-গণদের হাদিস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দেয় এবং ইসলামী অর্থনীতির একটি মূলনীতি হিসেবে অর্থনৈতিক ন্যায়কে দেখে। কারণ নবী-রাসূলদের আগমন ও প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য হল সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, তাই ইসলামে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কুরআন শরীফে সরকার গঠন ও নবী-রাসূলদের প্রেরণের উদ্দেশ্য হিসেবে "ন্যায় এবং সাম্য প্রতিষ্ঠা" এবং মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের মতবিরোধ সমাধান করার কথা বলা হয়েছে (সুরা বাকারা, আয়াত ১১৩ এবং সুরা হাদিদ, আয়াত ২৫)।
অন্যান্য অর্থনৈতিক মতবাদসমূহও সমাজের কল্যাণের জন্য সামাজিক মঙ্গল নিশ্চিত করাকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে, তবে ইসলামের শিক্ষা হল, সামাজিক মঙ্গলের পাশাপাশি মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং আল্লাহর প্রতি নৈকট্য লাভই সমাজের চূড়ান্ত লক্ষ্য। অন্যদিকে, অবৈধ মতবাদগুলো পার্থিব জীবনকে কেন্দ্র করে এবং পরকালীন জীবনের প্রতি বিশ্বাস না থাকায় শুধুমাত্র সামাজিক মঙ্গলকে শেষ লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এই কারণেই ইসলামিক দর্শনে ন্যায়, অধিকার এবং নৈতিকতার মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান, কারণ ইসলামী আইন একটি নৈতিক ব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠিত। যদি আইনগত নির্দেশনা বা বিধানগুলি সঠিক মনোভাব এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে পালন করা হয়, তবে তা নৈতিক কর্তব্য হিসেবে গণ্য হয়। এই সম্পর্কই ইসলামী ফিকহে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায় ও অবিচারের প্রতিরোধের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং সব ফিকহি বিধান এই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে, যেমন "কোনো ক্ষতি করা যাবে না" বা উৎপাদন এবং বিতরণের মালিকানা সংক্রান্ত বিধানসমূহ, যা সবই ন্যায় এবং প্রাপ্যতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
ইমাম আলী (আ.) ছিলেন একজন মহান নেতা, যিনি প্রায় ৪ বছর ৯ মাস বিশ্বের একটি বৃহত্তম সাম্রাজ্যে শাসন করেছিলেন। তিনি ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেছেন, যা মুসলিমদের জন্য একটি দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। ইমাম আলী (আ.)-এর চিন্তাধারার প্রধান বই এবং প্রামাণিক দলিল হলো নাহজুল বালাগা, যা ৪০০ হিজরীতে শরিফ রাজি কর্তৃক সংগৃহীত হয়েছিল এবং এতে ইমামের ভাষণ, চিঠি এবং বাণীসমূহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই প্রবন্ধে ইমাম আলী (আ.)-এর ন্যায় এবং অর্থনৈতিক ন্যায় সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটি ইসলামী সরকারে এটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য উপায়সমূহ নিয়ে আলোচনা করা হবে।
২) ইমাম আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে ন্যায় এবং ন্যায্যতার অর্থ ও ধারণা
ইমাম আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে, ন্যায় এবং ন্যায্যতার কিছু ভিন্ন ভিন্ন অর্থ এবং ধারণা রয়েছে:
১) ইমাম আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে ন্যায় এবং ন্যায্যতার এক অর্থ হল, "প্রতিটি মানুষের প্রকৃত অধিকার তাকে প্রদান করা"। ইমাম আলী (আ.) জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠাকে একটি ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়া এবং ইসলামী শাসকের একটি দায়িত্ব হিসেবে মনে করেন, এবং এ বিষয়ে তিনি বলেন:
"আমার কাছে সবচেয়ে অধম মানুষও সম্মানিত, যতক্ষণ না আমি তার অধিকার ফিরিয়ে দেই, এবং শক্তিশালী মানুষও আমার কাছে তুচ্ছ এবং দুর্বল, যতক্ষণ না আমি তার অধিকার ফিরিয়ে না দিই।" (নাহজুল বালাগা, খুতবা ৩৭, পৃ. ৯১)
"একজন মানুষকে দোষারোপ করা উচিত নয় যদি সে তার অধিকার কিছুটা বিলম্বে গ্রহণ করে, দোষারোপ সেই জায়গায় হওয়া উচিত যেখানে কেউ তার প্রাপ্য নয় এমন কিছু গ্রহণ করে।" (নাহজুল বালাগা, হিকমত ১৬৬, পৃ. ৬৬৭)
"কোনো ন্যায়ের চেয়ে বড় উপকারি কাজ নেই, তা হলো মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া এবং ঋণ পরিশোধ করা।" (ঘররুল হিকম, ১, পৃ. ১৮৭)
২) ইমাম আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে ন্যায়ের আরেকটি অর্থ হল "ইনসাফ" (সাধু বিচার)। ইনসাফ মানে হচ্ছে ন্যায়সঙ্গত এবং সঠিক আচরণ, যা ন্যায্যতার মূল ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ (ফারহাঙ্গে মোওয়াসির, পৃ. ১৫৩)।
এ বিষয়ে ইমাম আলী (আ.) বলেন:
"আল্লাহ ন্যায় এবং দান করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। ন্যায় হলো ইনসাফের প্রতি শ্রদ্ধা, এবং দান হলো উপহার ও অনুগ্রহ।" (নাহজুল বালাগা, হিকমত ২৩১, পৃ. ৬৭৯)
একদিন ইমাম আলী (আ.)-এর কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ন্যায় কি শ্রেষ্ঠ না দান?
তিনি বলেছিলেন:
"ন্যায় এবং ন্যায্যতা প্রতিটি বস্তুকে তার স্থান ও অধিকার প্রদান করে, যেখানে দান তা স্থানচ্যুত করে। ন্যায় হলো জনগণের জন্য সাধারণ নীতি, যেখানে দান একটি নির্দিষ্ট দলের জন্য। সুতরাং, ন্যায় শ্রেষ্ঠ এবং গুরুত্বপূর্ণ।" (নাহজুল বালাগা, হিকমত ৪৩৭, পৃ. ৭৩৫)
ইমাম আলী (আ.) আরও বলেন: "সত্যিই, ন্যায় ও ন্যায্যতা হলো, যখন আপনি বিচার করেন, তখন ইনসাফের সাথে বিচার করুন এবং অন্যায়ের থেকে দূরে থাকুন।" (ঘররুল হিকম, পৃ. ২২০)
ইমাম আলী (আ.)-এর বাণী এবং শিক্ষাগুলি থেকে এটা স্পষ্ট যে, তিনি ন্যায়কে মান্য করেন ইনসাফের মাধ্যমে, যার মানে হলো সমাজের বিভিন্ন মানুষের অধিকার সঠিকভাবে এবং সুষমভাবে প্রদান করা। ইনসাফের মানে হল যে, প্রতিটি বিষয় তার সঠিক স্থান ও অধিকার অনুসারে পালন করা উচিত। অন্য কথায়, সকল ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা এবং অতিরিক্ত বা অভাবিত কিছু না করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায় এবং ন্যায্যতার বিপরীত হল অন্যায় এবং অত্যাচার, এবং প্রতিটি মুসলমানের ওপর এটি বাধ্যতামূলক যে, তারা শুধু অন্যদের প্রতি অবিচার করবে না, বরং যারা অবিচার করে, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করবে।
৩) ইমাম আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে একটি ইসলামী সমাজে ন্যায় ও ন্যায্যতার প্রতিষ্ঠার উপকারিতা
ইসলাম সমাজের প্রতিটি ভিত্তি ও স্থিতিশীলতার মূল হিসেবে ন্যায় এবং ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, এবং ন্যায়ের বিপরীতে অত্যাচার ও অবিচারকে এমন একটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা সমাজের শাসনব্যবস্থার পতন এবং ধ্বংসের কারণ হতে পারে।
ইমাম আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে, সমাজে ন্যায় এবং ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা একটি ধর্মীয় কর্তব্য এবং এটি সরকার এবং শাসকদের কার্যক্রমের ভিত্তি। এখানে ইমাম আলী (আ.)-এর ন্যায় ও ন্যায্যতার প্রতিষ্ঠার উপকারিতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু মন্তব্য দেওয়া হল:
১) "ন্যায় হল শাসকদের সৌন্দর্য এবং আকর্ষণ।" (গেরারুল হিকাম, পৃ. ৫০)
২) "শাসনের সৌন্দর্য হল সরকারে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা।" (গেরারুল হিকাম, পৃ. ১৬৫)
৩) "যে ব্যক্তি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে, তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, এবং যে ব্যক্তি অবিচার করে, সে পতিত হয়।" (গেরারুল হিকাম, পৃ. ৬২৫)
৪) "ন্যায় প্রতিষ্ঠা কর এবং অন্যায়ের থেকে দূরে থাকো, কারণ অন্যায় মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে এবং অবিচার সশস্ত্র বিদ্রোহের দিকে ঠেলে দেয়।" (নাহজুল বালাগা, হিকমত ৪৭৬, পৃ. ৭৪৩)
যেমন দেখা যাচ্ছে, ইমাম আলী (আ.) একজন শাসক এবং জনগণের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠাকে একান্তভাবে একটি ধর্মীয় কর্তব্য এবং সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করেছেন, এবং সমাজে অবিচার এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে একটি নৈতিক কর্তব্য হিসেবে গণ্য করেছেন। অতএব, ইসলামী শাসনে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ন্যায় প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ইমাম আলী (আ.) একে তত্ত্ব এবং প্রয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্ব দিয়ে অনুসরণ করেছেন।
আপনার কমেন্ট